মহররম মাসের দশম দিন, মুসলমানদের কাছে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মহান দিবস। ইতিহাসে এই দিনটি চিহ্নিত হয়ে আছে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রিয় নাতী হজরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদতের মাধ্যমে। আশুরা শুধু শোকের দিন নয়, বরং ঈমানের পুনরুজ্জীবন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের দিন। এই দিনে মুসলমানরা রোজা রাখেন, নফল নামাজ আদায় করেন, দান-সদকা করেন এবং হজরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ও তাঁর পরিবারের স্মরণে দোয়া করেন। আশুরার ফজিলত ও আমল সম্পর্কে জানা প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য। এই আর্টিকেলে আমরা আশুরার ফজিলত ও আমল সম্পর্কে আলোচনা করবো।
মহররম মাসের গুরুত্ব
ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস ‘মহররম’। আল্লাহ তাআলা এই মাসকে বিশেষ মর্যাদা ও বরকত দান করেছেন। পবিত্র কোরআনে চারটি মাসকে সম্মানিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে মহররম অন্যতম। আল্লাহ বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে আল্লাহর কিতাবে (অর্থাৎ লাওহে মাহফুজে) মাসের সংখ্যা ১২টি, সেই দিন থেকে, যেদিন আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। এর মধ্যে চারটি মাস মর্যাদাপূর্ণ। (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩৬)
আবু বাকরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, … বারো মাসে এক বছর। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। জিলকদ, জিলহজ ও মুহররম। তিনটি মাস পরস্পর রয়েছে। আর একটি মাস হলো রজব, যা জুমাদাল আখিরা ও শাবান মাসের মাঝে অবস্থিত। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩১৯৭)
অন্য হাদিসে এসেছে, (রমজানের পর) শ্রেষ্ঠ মাস হচ্ছে আল্লাহর মাস, যাকে তোমরা মহররম বলে থাকো। (সুনানে কুবরা, হাদিস : ৪২১৬)
মহররম মাসের রোজা
রমজানের পর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ রোজা রাখার মাস হল মহররম। হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “রমজানের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মহররমের রোজা।” [সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬৪৫]
ইমাম ইবনে রজব (রহঃ) বলেন, আমাদের পূর্বসূরিরা তিন দশককে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন: রমজানের শেষ ১০ দিন, জিলহজের প্রথম ১০ দিন এবং মহররমের প্রথম ১০ দিন। [লাতাইফুল মাআরিফ]
মহররম মাসে রোজা রাখার ফজিলতঃ-
- হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মহররমের দশম দিন রোজা রাখবে, সে যেন এক বছর রোজা রেখেছে।” [মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৬৮৫৯]
- হজরত ইমাম জাফর সাদিক (রাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মহররমের প্রথম দশ দিন রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ৭০ বছরের পাপ মোচন হয়ে যাবে।” [কানজুল উম্মাল, হাদিস : ৩৭৫৮]
- মহররমের রোজা রাখা মুমিনের ঈমানের শক্তি বৃদ্ধি করে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভে সহায়তা করে।
আশুরার তাৎপর্য, ফজিলত ও আমল
মহররম মাসের ১০ তারিখ, যা আশুরা নামে পরিচিত, ইসলামে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, যা মুসলিমদের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
আশুরার তাৎপর্য:
- আল্লাহর নবীদের উপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ:
- এই দিনে নবী মুসা (আঃ) ও তাঁর সম্প্রদায় ফিরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।
- নবী ইউনুস (আঃ) তিমিংগলের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।
- হজরত আইয়ুব (আঃ) রোগমুক্তি লাভ করেছিলেন।
- হজরত ইব্রাহিম (আঃ) নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে নিরাপদে বেরিয়ে এসেছিলেন।
- হজরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ও তাঁর শহীদ সঙ্গীদের শাহাদত:
- ইতিহাসে আশুরার সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা হল হজরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) ও তাঁর শহীদ সঙ্গীদের শাহাদত।
- ন্যায়বিচার, সত্য ও স্বাধীনতার জন্য তাঁদের ত্যাগ স্মরণ করে মুসলিমরা এই দিন শোক পালন করে।
আশুরার ফজিলত:
- হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আশুরার দিন রোজা রাখবে, সে যেন এক বছর রোজা রেখেছে।” [মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৬৮৫৯]
- হজরত ইমাম জাফর সাদিক (রাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মহররমের প্রথম দশ দিন রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ৭০ বছরের পাপ মোচন হয়ে যাবে।” [কানজুল উম্মাল, হাদিস : ৩৭৫৮]
- মহররমের রোজা রাখা মুমিনের ঈমানের শক্তি বৃদ্ধি করে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভে সহায়তা করে।
আশুরার আমল:
- রোজা রাখা
- নফল নামাজ আদায় করা
- দান-সদকা করা
- আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা
কোন দিন রোজা রাখবেন?
মহানবী (সাঃ) মহররম মাসের ১০ তারিখ, আশুরা, সাথে ৯ বা ১১ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। যদি সম্ভব হয়, ৯ তারিখে রোজা রাখাই উত্তম। কারণ হাদিসে ৯ তারিখের রোজার কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
হাদিসের নির্দেশ:
- হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত: নবী (সাঃ) যখন আশুরার রোজা রাখছিলেন এবং অন্যদের রোজা রাখতে বলেছিলেন, তখন সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসুল! এ দিনকে তো ইহুদি-নাসারারা সম্মান করে?” নবীজি বললেন, “ইনশাআল্লাহ, আগামী বছর আমরা নবম তারিখেও রোজা রাখব।” [সহীহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৫৬]
- ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলতেন: “তোমরা ৯ তারিখ এবং ১০ তারিখ রোজা রাখো এবং ইয়াহুদিদের বিরোধিতা করো।” [জামে তিরমিজি, হাদিস : ৭৫৫]
যত বেশি তওবা করতে থাকা
তাওবা-ইস্তিগফার যেকোনো সময়ই গুরুত্বপূর্ণ আমল। তবে কিছু নির্দিষ্ট সময় থাকে যখন তাওবার পরিবেশ আরও অনুকূল হয়ে ওঠে। একজন মুসলিমের উচিত সেই মুহুর্তগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো। মহররম মাস, বিশেষ করে আশুরা (১০ম তারিখ), এমনই একটি মোক্ষম সময়। এই দিনে তাওবা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, নিরাপত্তা ও অদৃশ্য সাহায্য লাভের আশাও থাকে।
এই সময়ে আমাদের উচিত এমন কিছু আমলের প্রতি মনোনিবেশ করা যা আল্লাহর রহমত আমাদের দিকে আকৃষ্ট করে:
- তাওবা-ইস্তিগফার:
- এই মাসে প্রচুর তাওবা-ইস্তিগফার করা।
- পাপের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করা এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া।
- ভবিষ্যতে পাপ থেকে বিরত থাকার প্রতিজ্ঞা করা।
- নফল ইবাদত:
- নফল নামাজ, রোজা, দান-সদকা, তিলাওয়াতে কুরআন ইত্যাদি নফল ইবাদত বৃদ্ধি করা।
- দুঃস্থদের সাহায্য:
- দরিদ্র ও অভাবীদের সাহায্য করা।
- তাদের প্রতি সহানুভূতি ও দয়া প্রদর্শন করা।
- শ্রদ্ধা-ভক্তি:
- আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি বৃদ্ধি করা।
- ধর্মীয় বিধি-নিষেধ মেনে চলা।
- নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা।
উপসংহার
আল্লাহ আমাদের সকলকে আশুরার ফজিলত জেনে ও বুঝে আমল করার তওফিক দান করুন, আমীন। আশা করি আপনারা আমাদের আর্টিকেল থেকে আশুরার ফজিলত ও আমল সম্বন্ধে ধারণা লাভ করতে পেরেছেন। আমাদের আর্টিকেলটি ভালো লেগে থাকলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে আমাদের সাথেই থাকবেন। ধন্যবাদ।