পালং শাক – সবুজ শাকসবজির রাজা বলা হলে অত্যুক্তি হবে না। এই ছোট্ট পাতায় লুকিয়ে রয়েছে অগণিত পুষ্টিগুণ। ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট – পালং শাকে সবই আছে প্রচুর পরিমাণে। তাই স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের খাদ্যতালিকায় পালং শাকের জায়গা সবসময় থাকে। কিন্তু সবকিছুরই একটা সীমা আছে। পালং শাক খাওয়ারও কিছু নিয়মকানুন আছে। অতিরিক্ত পালং শাক খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এই আর্টিকেলে আমরা পালং শাকের বিভিন্ন উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। জানব, কারা পালং শাক বেশি পরিমাণে খেতে পারে এবং কারাদের জন্য পালং শাক খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত। তাহলে চলুন শুরু করা যাক পালং শাকের রহস্যময় জগতে যাত্রা।
পালং শাকের পুষ্টিগুণ (প্রতি ১০০ গ্রামে)
পালং শাক একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর শাক। প্রতি ১০০ গ্রাম পালং শাকে পাওয়া যায়:
- প্রোটিন: শরীর গঠন ও মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন আছে প্রায় ২ গ্রাম।
- কার্বোহাইড্রেট: শরীরের শক্তির উৎস কার্বোহাইড্রেট আছে প্রায় ২.৮ গ্রাম।
- আয়রন: রক্ত তৈরিতে সাহায্যকারী আয়রন আছে প্রায় ১১.২ মিলিগ্রাম।
- ফসফরাস: হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় ফসফরাস আছে প্রায় ২০.৩ মিলিগ্রাম।
- নিকোটিনিক এসিড: শরীরের বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সাহায্যকারী নিকোটিনিক এসিড আছে প্রায় ০.৫ মিলিগ্রাম।
- অক্সালিক এসিড: এই এসিডের পরিমাণ কিছুটা বেশি হলেও, এটি খনিজ পদার্থ শোষণে বাধা দিতে পারে।
- ক্যালসিয়াম: হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্যালসিয়াম আছে প্রায় ৭৩ মিলিগ্রাম।
- পটাশিয়াম: রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্যকারী পটাশিয়াম আছে প্রায় ২০৮ মিলিগ্রাম।
- আঁশ: পাচনতন্ত্র স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী আঁশ আছে প্রায় ০.৭ গ্রাম।
- ভিটামিন: পালং শাকে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন রয়েছে, যেমন ভিটামিন এ (প্রায় ৯৩০০ আইইউ), রিবোফ্লোবিন (প্রায় ০.০৮ মিলিগ্রাম), ভিটামিন সি (প্রায় ২৭ মিলিগ্রাম) এবং থায়ামিন (প্রায় ০.০৩ মিলিগ্রাম)।
পালং শাক এর উপকারিতা
১) চোখ ভালো রাখে
সবুজ শাক সবজি আমাদের চোখের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এই শাকগুলোতে বিভিন্ন ধরনের উপাদান থাকে যা চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। পালং শাক এই ধরনের শাকসবজির মধ্যে অন্যতম। এতে বিটা ক্যারোটিন নামক একটি উপাদান প্রচুর পরিমাণে থাকে। এই বিটা ক্যারোটিন চোখের ছানি পড়া রোধ করতে সাহায্য করে।
২) ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো রাখে
পালং শাক শুধু চোখের জন্যই উপকারী নয়, ত্বকের জন্যও এটি অত্যন্ত উপকারী একটি সবজি। পালং শাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ থাকে। এই ভিটামিন এ আমাদের ত্বকের জন্য অনেক উপকারী। পালং শাকের অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি ত্বকের কোষগুলিকে মুক্ত র্যাডিকেলের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। ফলে ত্বকে বয়সের ছাপ পড়া ধীরে ধীরে হয়। পালং শাকের ভিটামিন এ আমাদের ত্বককে ভেতর থেকে আর্দ্র রাখতে সাহায্য করে। ফলে ত্বক শুষ্ক হয়ে ফাটার সমস্যা কম হয়। পালং শাকের অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি ত্বকের কোষগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে। ফলে ব্রণ, বলিরেখা এবং অন্যান্য ত্বকের সমস্যা কম হয়। পালং শাকের ভিটামিন এ ত্বকের কোষগুলিকে নতুন করে গঠন করতে সাহায্য করে। ফলে ত্বক নরম, মসৃণ এবং স্থিতিস্থাপক হয়ে ওঠে।
৩) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
পালং শাক শুধু চোখ ও ত্বকের জন্যই উপকারী নয়, এটি আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়াতে সাহায্য করে। পালং শাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ থাকে। এই ভিটামিন এ আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। পালং শাক শরীরে শ্বেত রক্তকণিকার পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে। এই শ্বেত রক্তকণিকা আমাদের শরীরকে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
৪) ওজন কমায়
পালং শাক হলো ওজন কমানোর জন্য একটি দারুণ খাবার। কেন? কারণ পালং শাকে খুবই কম ক্যালোরি থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম পালং শাকে মাত্র ৭ ক্যালোরি থাকে। অর্থাৎ, আপনি অনেক পরিমাণে পালং শাক খেলেও খুব কম ক্যালোরি গ্রহণ করবেন। কম ক্যালোরি গ্রহণ মানে হলো আপনার শরীরের চর্বি কমবে এবং ওজন কমবে।
৫) রক্তচাপ কমায়
পালং শাক শুধু ওজন কমাতেই নয়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও খুবই উপকারী। পালং শাকে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম থাকে। এই ম্যাগনেসিয়াম আমাদের শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। তাই যাদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে, তারা নিয়মিত পালং শাক খেতে পারেন।
৬) শরীরের প্রদাহ কমায়
পালং শাক শুধু রক্তচাপ কমাতে বা ওজন কমাতেই নয়, শরীরে প্রদাহ কমাতেও খুবই উপকারী। পালং শাকে নিওজেন্থিন নামক একটি উপাদান রয়েছে। এই উপাদানটি শরীরে প্রদাহ কমাতে খুবই কার্যকরী। যাদের জয়েন্টে ব্যাথা, অর্থাৎ যৌথ ব্যথার সমস্যা আছে, তাদের জন্য পালং শাক খুবই উপকারী। তাই যাদের জয়েন্টে ব্যথা, আর্থ্রাইটিস বা অন্য কোন প্রদাহজনিত সমস্যা আছে, তারা নিয়মিত পালং শাক খেতে পারেন।
৭) হার্ট ভালো রাখে
পালং শাক শুধু চোখ, ত্বক আর শরীরের জন্যই ভালো নয়, এটি আমাদের হৃদয়ের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। পালং শাকে প্রচুর পরিমাণে ফলিক এসিনেজা থাকে। এই ফলিক এসিনেজা আমাদের হার্টকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। তাই যারা হৃদরোগে ভুগছেন বা হৃদরোগের ঝুঁকিতে আছেন, তারা নিয়মিত পালং শাক খেতে পারেন।
৮) ক্যান্সার প্রতিরোধ করে
পালং শাক শুধু শরীরের জন্য পুষ্টিকর খাবারই নয়, এটি ক্যান্সারের মতো ভয়ানক রোগের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে সাহায্য করে। পালং শাকে প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাভোনয়েড নামক একটি উপাদান রয়েছে। এই ফ্ল্যাভোনয়েড আমাদের শরীরের কোষগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে। ফলে ক্যান্সারের কোষ গঠনের সম্ভাবনা কমে যায়। পালং শাকের ফ্ল্যাভোনয়েড আমাদের শরীরে তৈরি হওয়া ফ্রি র্যাডিকেলকে নিরপেক্ষ করে। এই ফ্রি র্যাডিকেলই ক্যান্সারের মতো ভয়ানক রোগের কারণ। তাই সুস্থ থাকতে এবং ক্যান্সারের মতো ভয়ানক রোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে নিয়মিত পালং শাক খাওয়া উচিত।
পালং শাক এর অপকারিতা
পালং শাক খুবই উপকারী সবজি হলেও, অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
কারণঃ-
- অক্সালিক অ্যাসিড: পালং শাকে প্রচুর পরিমাণে অক্সালিক অ্যাসিড থাকে। এই অ্যাসিড শরীরে থাকা ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক এবং ম্যাগনেসিয়ামের সাথে মিশে কিডনিতে পাথর তৈরি করতে পারে।
- পিউরিন: পালং শাকে পিউরিন নামক একটি যৌগও থাকে। এই যৌগ গাউট রোগীদের জন্য ক্ষতিকর।
- ভিটামিন কে: পালং শাকে ভিটামিন কে প্রচুর পরিমাণে থাকে। যারা রক্ত পাতলা করার ওষুধ খান, তাদের জন্য ভিটামিন কে খুব বেশি হলে ক্ষতিকর হতে পারে।
- অ্যালার্জি: কিছু মানুষের পালং শাকের প্রতি অ্যালার্জি থাকতে পারে।
অতিরিক্ত পালং শাক খাওয়ার ফলে হতে পারেঃ-
- কিডনিতে পাথর
- গাউট রোগ বাড়তে পারে
- রক্ত পাতলা হওয়ার সমস্যা
- পেট ফোলা, গ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য
- শরীরে অন্যান্য খনিজের ঘাটতি
যাদের পালং শাক কম খাওয়া উচিতঃ-
- কিডনির সমস্যা থাকলে
- গাউট রোগী
- রক্ত পাতলা করার ওষুধ খাওয়া রোগী
- অ্যালার্জি থাকলে
উপসংহার
আশাকরি আজকের এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনারা পালং শাক এর উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পেরেছেন। পালং শাক একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর সবজি যা আমাদের শরীরকে অনেক উপকার দেয়। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পালং শাক রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, ওজন কমাতে সাহায্য করে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। তবে সব কিছুর মতো পালং শাকও অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া উচিত নয়। অতিরিক্ত পালং শাক খেলে শরীরে অক্সালিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে যা কিডনিতে পাথর তৈরি করতে পারে। এছাড়াও, পালং শাকের কারণে গাউট রোগ, রক্ত পাতলা হওয়ার সমস্যা এবং অ্যালার্জিও হতে পারে। সুতরাং, পালং শাক একটি স্বাস্থ্যকর খাবার হলেও, সবকিছুর মতো পালং শাকও মধ্যস্থতা বজায় রেখে খাওয়া উচিত। আর্টিকেলটি ভালো লাগলে অবশ্যই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন I ধন্যবাদ।