পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় সূরা বাকারা মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর শেষ দুটি আয়াত, বিশেষ ফজিলত ও বরকত ধারণ করে। এই আয়াত দুটি তেলাওয়াতের মাধ্যমে ঈমানের আলোয় জীবনকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করা সম্ভব। এই আর্টিকেলে আমরা সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াতের ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করবো। হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত এই আয়াত দুটি তেলাওয়াতের ফলে যেসব অনুপম বরকত লাভ করা যায়, তার বিস্তারিত বিবরণ আমরা তুলে ধরবো। পাশাপাশি, এই আয়াত দুটির অর্থ ও শব্দের সঠিক উচ্চারণ সম্পর্কেও জ্ঞান অর্জন করবো।
সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত বাংলা উচ্চারণ
اٰمَنَ الرَّسُوۡلُ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡهِ مِنۡ رَّبِّهٖ وَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ؕ کُلٌّ اٰمَنَ بِاللّٰهِ وَ مَلٰٓئِکَتِهٖ وَ کُتُبِهٖ وَ رُسُلِهٖ ۟ لَا نُفَرِّقُ بَیۡنَ اَحَدٍ مِّنۡ رُّسُلِهٖ ۟ وَ قَالُوۡا سَمِعۡنَا وَ اَطَعۡنَا ٭۫ غُفۡرَانَکَ رَبَّنَا وَ اِلَیۡکَ الۡمَصِیۡرُ لَا یُکَلِّفُ اللّٰهُ نَفۡسًا اِلَّا وُسۡعَهَا ؕ لَهَا مَا کَسَبَتۡ وَ عَلَیۡهَا مَا اکۡتَسَبَتۡ ؕ رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذۡنَاۤ اِنۡ نَّسِیۡنَاۤ اَوۡ اَخۡطَاۡنَا ۚ رَبَّنَا وَ لَا تَحۡمِلۡ عَلَیۡنَاۤ اِصۡرًا کَمَا حَمَلۡتَهٗ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِنَا ۚ رَبَّنَا وَ لَا تُحَمِّلۡنَا مَا لَا طَاقَۃَ لَنَا بِهٖ ۚ وَ اعۡفُ عَنَّا ٝ وَ اغۡفِرۡ لَنَا ٝ وَ ارۡحَمۡنَا ٝ اَنۡتَ مَوۡلٰىنَا فَانۡصُرۡنَا عَلَی الۡقَوۡمِ الۡکٰفِرِیۡنَ
উচ্চারণ: আমানার রাসুলু বিমা উংঝিলা ইলাইহি মির রাব্বিহি ওয়াল মু’মিনুন। কুল্লুন আমানা বিল্লাহি ওয়া মালা-ইকাতিহি ওয়া কুতুবিহি ওয়া রুসুলিহ। লা-নুফাররিকু বাইনা আহাদিম মির রুসুলিহ। ওয়া কালু সামি’না ওয়া আত্বা’না গুফরানাকা রাব্বানা ওয়া ইলাইকাল মাসির। লা ইউকাল্লিফুল্লাহু নাফসান ইল্লা উসআহা লাহা মা কাসাবাত ওয়া আলাইহা মাকতাসাবাত রাব্বানা লা তুআখিজনা ইন-নাসীনা আও আখত্ব’না রাব্বানা ওয়ালা তাহমিল আলাইনা ইসরাং কামা হামালতাহু আলাল্লাজীনা মিং কাবলিনা রাব্বানা ওয়ালা তুহাম্মিলনা মা লা ত্বাকাতালানা বিহ। ওয়া’ফু আন্না ওয়াগফিরলানা ওয়ারহামনা আংতা মাওলানা ফাংসুরনা আলাল কাওমিল কাফিরিন।
অর্থ: রাসুল তার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে নাজিলকৃত বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছে, আর মুমিনগণও। প্রত্যেকে ঈমান এনেছে আল্লাহর ওপর, তাঁর ফেরেশতাকুল, কিতাবসমূহ ও তাঁর রাসুলগণের ওপর, আমরা তাঁর রাসুলগণের মধ্যে তারতম্য করি না। আর তারা বলে, আমরা শুনলাম এবং মানলাম। হে আমাদের রব! আমরা আপনারই কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি, আর আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তনস্থল। আল্লাহ কোনো ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না। সে ভাল যা করেছে তার সওয়াব পাবে এবং মন্দ কর্মের জন্য সে নিজেই নিগ্রহ ভোগ করবে। হে আমাদের রব! আমরা যদি ভুলে যাই, অথবা ভুল করি তাহলে আপনি আমাদেরকে পাকড়াও করবেন না। হে আমাদের রব! আমাদের উপর বোঝা চাপিয়ে দেবেন না, যেমন আমাদের পূর্ববর্তীদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। হে আমাদের রব! আপনি আমাদের এমন কিছু বহন করাবেন না, যার সামর্থ্য আমাদের নেই। আর আপনি আমাদের মার্জনা করুন এবং আমাদের ক্ষমা করুন, আর আমাদের উপর দয়া করুন। আপনি আমাদের অভিভাবক। অতএব আপনি কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন।
সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াতের অবতীর্ণের সময় ও তাৎপর্য
হাদিসের বর্ণনা অনুসারে, সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর মিরাজের রাতে অবতীর্ণ হয়েছিল। মিরাজের সময়, নবী (সাঃ) আকাশে উঠে জান্নাত, জাহান্নাম, সিদরাতুল মুনতাহা সহ বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেছিলেন। ঐ রাতেই তাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত উপহার দেওয়া হয়েছিল।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসেও এই তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায়। নবী (সাঃ) বলেছেন, “যখন আমাকে সিদরাতুল মুনতাহায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখন আমাকে তিনটি জিনিস উপহার দেওয়া হয়েছিল: ১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, ২. সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত, ৩. উম্মতের মধ্যে যারা শিরক করে না তাদের কবিরা গুনাহ মাফ হওয়ার সুসংবাদ।” (মুসলিম, তাফসিরে মাজহারি)
সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াতের ফজিলত
হাদিসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, রাতের বেলা ঘুমানোর পূর্বে সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত তেলাওয়াত করলে তাহাজ্জুদ নামাজের সমান সওয়াব পাওয়ার আশা করা যেতে পারে।
এই ফজিলত সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে নিম্নলিখিত হাদিসগুলোতে:-
হাদিস ১:-
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি রাতের বেলা সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত পড়বে সেটা তার জন্য যথেষ্ঠ হবে।” (সহীহ বুখারি ও সহীহ মুসলিম)
এই হাদিস থেকে স্পষ্ট যে, রাতের বেলা সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত তেলাওয়াত করলে একজন ব্যক্তি তাহাজ্জুদ নামাজের সওয়াব লাভ করতে পারবেন। তাহাজ্জুদ নামাজ একটি বিশেষ নফল নামাজ যা রাতের শেষভাগে আদায় করা হয়। এই নামাজের ফজিলত অপরিসীম এবং এটি ঈমানের শক্তি বৃদ্ধি করে ও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে সহায়তা করে।
হাদিস ২:-
হজরত আবু মাসউদ (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “যে সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত রাতে পাঠ করবে, তার জন্য এ দুটি আয়াত যথেষ্ট হবে; অর্থাৎ সারারাত সে জিন ও মানুষের অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকবে এবং প্রতিটি অপ্রিয় বিষয় থেকে তাকে হেফাজত করা হবে।” (সহীহ বুখারি ও সহীহ মুসলিম)
এই হাদিসটিতে আরও কিছু ফজিলতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, রাতের বেলা সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত তেলাওয়াত করলে জিন ও মানুষের অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকা যায় এবং সকল অপ্রিয় বিষয় থেকে হেফাজত পাওয়া যায়।
হাদিস ৩:-
হজরত জুবায়ের ইবনু নুফায়র (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
“আল্লাহ তাআলা সুরা আল-বাকারাকে এমন দুটি আয়াত দ্বারা শেষ করেছেন, যা আমাকে আল্লাহর আরশের নীচের ভাণ্ডার থেকে দান করা হয়েছে। তাই তোমরা এ আয়াতগুলোকে শিখবে। তোমাদের স্ত্রীদেরও শেখাবে। কারণ এ আয়াতগুলো হচ্ছে রহমত, (আল্লাহর) নৈকট্য লাভের উপায়। (দীন দুনিয়ার সকল) কল্যাণ পাওয়ার দোয়া।” (মিশকাত ২১৭৩, দারেমি ৩০৬৮)
এই হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সুরা আল-বাকারার শেষ দুটি আয়াতের অসাধারণ ফজিলত ও গুরুত্বের উপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। এই দুটি আয়াতকে তিনি আল্লাহর আরশের নীচের ভাণ্ডার থেকে পাওয়া অমূল্য সম্পদ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
উল্লেখ্য যে, এই হাদিসগুলোর বর্ণিত ফজিলত লাভের জন্য অবশ্যই সঠিক উচ্চারণে এবং পূর্ণ মনোযোগ সহকারে সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত তেলাওয়াত করতে হবে।
উপসংহার
সুরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত আমাদের ঈমান, আমল ও দোয়ার ক্ষেত্রে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত এই আয়াত তেলাওয়াতের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ, রহমত লাভ এবং দুনিয়া-আখিরাতের সকল কল্যাণ লাভের প্রত্যাশা করতে পারি। মুসলমানদের উচিত নিয়মিতভাবে এই দুটি আয়াত তেলাওয়াত করা, এর অর্থ বুঝে জ্ঞান অর্জন করা এবং স্ত্রী-সন্তানদেরও শেখানো। এই আয়াতগুলো তেলাওয়াতের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও জান্নাতের পথ সুগম করতে পারি। আমাদের এই আর্টিকেলটি ভালো লেগে থাকলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে আমাদের সাথেই থাকবেন। ধন্যবাদ।