১৯৭৪ সাল, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অন্ধকার অধ্যায়। এই বছর দেশটি প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়, যার ফলে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটে এবং দেশের অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই দুর্ভিক্ষের কারণগুলি ছিল বহুমাত্রিক। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি, সরকারি নীতি, অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাও এই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের মার্চে শুরু হয়ে সেই বছরেরই ডিসেম্বরের দিকে গিয়ে শেষ হয়। এই আর্টিকেলে আমরা ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পেছনের কারণগুলি বিশ্লেষণ করব এবং এই দুর্ভিক্ষের ফলে দেশের ও জনগণের উপর যেসব প্রভাব পড়েছিল, সেগুলি তুলে ধরব। আমরা এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করব যেমন, এই দুর্ভিক্ষ থেকে আমরা কী শিখতে পারি এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে আমাদের কী করা উচিত।
এক নজরে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, তার পেছনে একাধিক কারণ কাজ করেছিল। এই দুর্ভিক্ষের পটভূমি বুঝতে হলে আমাদের দেশের তৎকালীন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পরিণত হয়েছিল। অর্থনীতি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল, উৎপাদন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর দেশের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে খাদ্যের চাহিদাও বেড়ে গিয়েছিল। এই সময় বাংলাদেশে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘন ঘন ঘটত। এসব দুর্যোগ ফসল নষ্ট করেছিল এবং খাদ্য উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছিল। সরকার খাদ্য মজুদ এবং বিতরণ ব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে খাদ্য সহায়তা অনেক সময় দরকারী মানুষের কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছিল দেশ থেকে ব্যাপক হারে খাদ্যশস্য পাচার হচ্ছিল, যা দুর্ভিক্ষের তীব্রতা বাড়িয়ে তুলেছিল। কিউবাকে পাট রপ্তানির কারণে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে খাদ্য সাহায্য বন্ধ করে দেয়, যা দুর্ভিক্ষের তীব্রতা বাড়িয়ে তুলেছিল। দেশের একটি বড় অংশ দরিদ্র ও শোষিত ছিল। তারা এই দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব অনুভব করেছিল।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কারণ
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এই দুর্ভিক্ষের কারণগুলি তার “Poverty and Famines” বইয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, সরকারের দুর্নীতি, খাদ্য আমদানিতে ব্যর্থতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী। দুর্ভিক্ষের সময় সরকার খাদ্য আমদানিতে ব্যর্থ হয়েছিল, বিশেষ করে কিউবাকে পাট রপ্তানির কারণে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে খাদ্য সাহায্য বন্ধ করে দেয়। ফলে, দেশে খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দেয় এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়। খাদ্যশস্যের সূষম বন্টনের অভাব এবং দূর্নীতি-স্বজনপ্রীতি, পার্শ্ববর্তী দেশে চোরাচালানী ইত্যাদি ছিল দূর্ভিক্ষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ একটি জটিল সমস্যা ছিল যার একাধিক কারণ ছিল। এই দুর্ভিক্ষ শুধুমাত্র খাদ্যের অভাবের কারণে হয়নি, বরং খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার ব্যর্থতার কারণেও হয়েছিল।
দুর্ভিক্ষের মূল কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:-
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ: বন্যা সবচেয়ে বড় কারণগুলির মধ্যে একটি ছিল। বন্যা ফসল নষ্ট করেছিল এবং অনেক মানুষকে তাদের বাড়িঘর হারাতে বাধ্য করেছিল।
- জনসংখ্যা বৃদ্ধি: দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাদ্যের চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল।
- সরকারি ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা: সরকার খাদ্য মজুদ এবং বিতরণ ব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
- খাদ্যের চলাচল সীমিতকরণ: জেলার মধ্যে খাদ্যশস্যের চলাচল সীমিত করার আইন খাদ্য সংকটকে আরও তীব্র করে তুলেছিল।
- খাদ্য পাচার: প্রতিবেশী দেশগুলিতে খাদ্যশস্য পাচারের ফলে দেশের মধ্যে খাদ্যের সরবরাহ কমে গিয়েছিল।
- বিতরণ ব্যবস্থার ব্যর্থতা: খাদ্য যদিও উৎপাদিত হয়েছিল, তবে তা দরকারী মানুষের কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছিল।
অনেক গবেষকের মতে, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে খাদ্যের উৎপাদন খুবই ভালো ছিল। তাহলে দুর্ভিক্ষ কেন হয়েছিল? উত্তর হল, খাদ্য যদিও উৎপাদিত হয়েছিল, তবে তা দরকারী মানুষের কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছিল। সরকারি রেশনিং ব্যবস্থা এবং বাজার ব্যবস্থার কিছু সমস্যার কারণে খাদ্যের দাম বেড়ে গিয়েছিল এবং সাধারণ মানুষের কাছে তা কেনার সামর্থ্য ছিল না। এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সহায়তা বন্ধ করে দেওয়াও দুর্ভিক্ষের তীব্রতা বাড়িয়ে তুলেছিল। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কিউবায় পাট রপ্তানি বন্ধ করতে চাপ দিয়েছিল এবং বাংলাদেশ যখন এই চাপ মেনে নিয়েছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল।
১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ একটি জাতীয় দুর্যোগ ছিল। এই দুর্ভিক্ষের কারণগুলির মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কিছু কারণও ছিল। এই দুর্ভিক্ষের সময় বাংলাদেশ থেকে ভারতে ব্যাপক হারে খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য পণ্য পাচার হয়েছিল। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছিল। পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুধার কারণে মারা যাচ্ছে এবং সরকার এই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী। প্রতিবেদনে স্থানীয় একজন অর্থনীতিবিদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছিল যে, দুর্ভিক্ষের মূল কারণ বন্যা নয়, বরং খাদ্যশস্যের চোরাচালান। বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতেও এই সময় চোরাচালানের বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। জনতার মুখপত্র নামক একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল যে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রায় ৫০০০ কোটি টাকার পণ্য পাচার হয়েছিল। মেজর অব: মো: রফিকুল ইসলাম বীরোত্তমও তার বইয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ব্যাপক হারে চাল-পাট পাচার হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
দুর্ভিক্ষের সময় সরকারের ব্যর্থতা এবং বিলাসিতা
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারের ব্যর্থতা এবং বিলাসিতার জীবনযাপন একটি চরম বিপরীত ছবি উপস্থাপন করে। একদিকে দেশের মানুষ ক্ষুধার কারণে মারা যাচ্ছিল, অন্যদিকে সরকারের উচ্চপদস্থরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করছিল।
সরকারের ব্যর্থতা:–
- লঙ্গরখানা ব্যবস্থার ব্যর্থতা: সরকার দুর্ভিক্ষের মোকাবিলায় লঙ্গরখানা খোলার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু এই ব্যবস্থা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। অনেক জেলায় লঙ্গরখানায় খাবারের অভাব ছিল এবং মানুষকে না খেয়ে থাকতে হয়েছিল।
- খাদ্য আমদানিতে ব্যর্থতা: দেশে খাদ্যের তীব্র সংকট থাকা সত্ত্বেও সরকার পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য আমদানি করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
- দুর্ভিক্ষের তথ্য গোপন: সরকার দুর্ভিক্ষের মাত্রা সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রকাশ করতে চায়নি।
- চোরাচালান: দেশ থেকে ব্যাপক হারে খাদ্যশস্য পাচার হচ্ছিল, যা দুর্ভিক্ষের তীব্রতা বাড়িয়ে তুলেছিল।
সরকারের বিলাসিতা:–
- শেখ মুজিবের জন্মদিনের আয়োজন: দেশে দুর্ভিক্ষের মধ্যেও শেখ মুজিবের জন্মদিন বড় ধামধাম করে পালন করা হয়েছিল।
- বিদেশি মদ ও সিগারেট আমদানি: সরকারি টাকায় বিদেশি মদ ও সিগারেট আমদানি করা হয়েছিল।
- শেখ কামাল এবং শেখ জামালের বিলাসবহুল বিয়ে: শেখ মুজিবের দুই ছেলের বিয়েতে অস্বাভাবিকভাবে বিলাসিতা করা হয়েছিল।
সরকারের এই বিপরীত চিত্র জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল এবং সরকারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে বাধ্য হয়েছিল।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে মোট কত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়। এই দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ মারা গিয়েছিল। মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে, তবে সবাই একমত যে, মৃত্যুর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ২৭,০০০ মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। তবে বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী, মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। বিভিন্ন অনুমান অনুযায়ী, ১ লাখ থেকে ৪ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল। রংপুর বিভাগ, বিশেষ করে কুড়িগাম জেলা, এই দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব অনুভব করেছিল। এই অঞ্চলে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি ছিল।
অনাহার ছিল মৃত্যুর প্রধান কারণ। তবে অনাহারের কারণে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ায় কলেরা, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়েও অনেকে মারা গিয়েছিল। দরিদ্র, শ্রমিক এবং ভূমিহীন মানুষরা এই দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব অনুভব করেছিল। ভূমিহীন পরিবারগুলিতে মৃত্যুর হার ভূমিধারী পরিবারের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। দুর্ভিক্ষের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে জন্মহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছিল।
উপসংহার
১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ একটি জাতীয় দুর্যোগ ছিল যার গভীর প্রভাব পড়েছিল জনগণের জীবনে। এই দুর্ভিক্ষের মূল কারণ ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সরকারি ব্যর্থতা, এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বন্যা, খরা, এবং অস্বাভাবিক আবহাওয়া এই দুর্ভিক্ষের তীব্রতা বাড়িয়ে তুলেছিল। সরকারের দুর্বল খাদ্য ব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, এবং চোরাচালান এই দুর্যোগকে আরও জটিল করে তুলেছিল। এই দুর্ভিক্ষের ফলে লক্ষাধিক মানুষ মারা গিয়েছিল, অর্থনীতি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল, এবং দেশের সামাজিক কাঠামোতে গভীর প্রভাব পড়েছিল। এই দুর্ভিক্ষ থেকে আমরা শিখতে পারি যে, খাদ্য সুরক্ষা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং সুশাসন একটি দেশের টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দুর্ভিক্ষের মতো ঘটনা যেন আর কখনো বাংলাদেশে ঘটতে না পারে, সেজন্য সরকারকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আরও সচেতন হতে হবে এবং দেশের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। জনগণকেও সচেতন হতে হবে এবং দুর্যোগের সময় সহযোগিতা করতে হবে।
তথ্যসুত্রঃ-