নিঃসন্দেহে, কুরআনুল কারিমের প্রতিটি অংশ – সূরা, আয়াত, এমনকি প্রতিটি হরফই নেকী ও সওয়াবের অফুরন্ত খনি। আল্লাহ তাআলার বাণী হিসেবে, সবকিছুই অতুলনীয় মর্যাদার অধিকারী। তবে, মহান আল্লাহ কিছু নির্দিষ্ট সূরা ও আয়াতের জন্য বিশেষ ফযীলত ও মর্যাদা নির্ধারণ করেছেন। এর উদ্দেশ্য হলো বান্দাদেরকে অধিক নেকী ও সওয়াব অর্জনের সুযোগ করে দেওয়া। কুরআনুল কারিমের ১১২ তম সূরা, সূরা ইখলাস, মাত্র চারটি আয়াতে সমৃদ্ধ হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। হিজরতের পূর্বে মক্কায় অবতীর্ণ এই সূরাটি আল্লাহর একত্ব ও তাঁর গুণাবলীর স্পষ্ট বর্ণনা প্রদান করে। এই আর্টিকেলে আমরা সূরা ইখলাসের বাংলা উচ্চারণ, অর্থ এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারব।
সুরা ইখলাস আরবি
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ – اللَّهُ الصَّمَدُ – لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ – وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ
সুরা ইখলাস বাংলা উচ্চারণ্
(১) কুল হুয়াল্লাহু আহাদ।
(২) আল্লাহুস সামাদ।
(৩) লাম ইয়ালিদ ওয়া লাম ইউলাদ।
(৪) ওয়া লাম ইয়াকুল্লাহু কুফুয়ান আহাদ।’
সুরা ইখলাস বাংলা অর্থ
(১) (হে রাসুল! আপনি) বলুন, তিনিই আল্লাহ, একক।
(২) আল্লাহ অমুখাপেক্ষী।
(৩) তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি।
(৪) আর তার সমতুল্য কেউ নেই।’
সুরা ইখলাসের নামকরণের তাৎপর্য
এই সূরার নামকরণ করা হয়েছে এর মূল বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে। “ইখলাস” শব্দের অর্থ “একনিষ্ঠতা”। সূরাটিতে আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর অসামান্য গুণাবলীর স্পষ্ট বর্ণনা থাকায় এর নামকরণ করা হয়েছে “ইখলাস”।
সুরা ইখলাস শানে নুযুল
হাদিস থেকে জানা যায়, সূরা ইখলাস নাজিলের পেছনে দুটি প্রধান কারণ ছিল:
১) খায়বারের ইহুদিদের প্রশ্নের জবাবে:
- ঘটনা: খায়বারের যুদ্ধের পর, কিছু ইহুদি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, “আল্লাহ কিভাবে তৈরি হয়েছেন?”
- রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতিক্রিয়া: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে কিছুক্ষণ চিন্তা করেন।
- হজরত জিবরিল (আঃ)-এর মাধ্যমে সূরা ইখলাসের অবতরণ: পরে হজরত জিবরিল (আঃ) সূরা ইখলাস নিয়ে হাজির হন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইহুদিদেরকে এই সূরা তেলাওয়াত করে শোনান।
- সূরা ইখলাসের মূল বার্তা: এই সূরাটিতে আল্লাহর একত্ববাদ, তাঁর অভাবমুক্ততা, সন্তানহীনতা এবং তুলনাহীনতার স্পষ্ট বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
২) নাজরান খ্রিস্টানদের প্রশ্নের জবাবে:
- ঘটনা: নাজরানের সাতজন খ্রিস্টান পাদ্রি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে দেখা করে এবং জিজ্ঞেস করে, “আপনার রব কেমন? তিনি কি তৈরি?”
- রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতিক্রিয়া: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে জানান যে আল্লাহ কোনো বস্তুর তৈরি নন, বরং তিনি সকল সৃষ্টি থেকে পৃথক।
- সূরা ইখলাসের অবতরণ: এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা সূরা ইখলাস নাজিল করেন।
সূরা ইখলাসের মুল বিষয়বস্তু
সূরা ইখলাস, মাত্র চারটি আয়াত সমৃদ্ধ হলেও, আল্লাহ তাআলার পরিচয় তুলে ধরার ক্ষেত্রে অতুলনীয়। এই সূরায় তিনি চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন যা মুসলিমদের ঈমানকে সুদৃঢ় করে:
১) আল্লাহ এক:
প্রথম আয়াতে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়। তাঁর কোনো সঙ্গী বা শরীক নেই। এই একত্ববাদই ইসলামের মূল ভিত্তি।
২) তিনি অমুখাপেক্ষী:
দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা সম্পূর্ণ স্বনির্ভর। তিনি কারো উপর নির্ভরশীল নন। বরং সকল সৃষ্টিই তাঁর উপর নির্ভরশীল।
৩) তিনি জন্ম-মৃত্যু থেকে মুক্ত:
তৃতীয় আয়াতে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা জন্মগ্রহণ করেননি এবং তাঁর মৃত্যুও হবে না। তিনি চিরন্তন এবং অবিনশ্বর।
৪) তাঁর তুলনা নেই:
চতুর্থ আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলার তুলনা কারো সাথে করা যাবে না। তিনি সকল সৃষ্টি থেকে পৃথক এবং অতুলনীয়।
সুরা ইখলাসের ফজিলত
- হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘এক ব্যক্তি রাতের বেলা অন্য ব্যক্তিকে বার বার সুরা ইখলাস পড়তে শুনেছেন। সকাল হলে বিষয়টি রাসুলু্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবহিহত করা হয়। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ওই সত্তার শপথ! যার কুদরতি হাতে আমার প্রাণ। অবশ্যই এ সুরা কুরআন মাজিদের এক-তৃতীয়াংশের সমান।’ (বুখারি, আবু দাউদ, নাসাঈ, মুয়াত্তা মালেক)
- একবার নবী মুহাম্মদ (সাঃ) সাহাবিদের একটি দলকে যুদ্ধে পাঠান। তাদের মধ্যে একজনকে সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। যুদ্ধ চলাকালীন দীর্ঘ সময় ধরে তিনি কেবলমাত্র সুরা ইখলাস দিয়ে নামাজ আদায় করতেন। যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে সৈন্যরা নবী (সাঃ) কে বিষয়টি অবহিত করেন। তখন নবী (সাঃ) তাদের নির্দেশ দেন, “তোমরা তাকে জিজ্ঞাসা করো, কেন সে এমন করেছে?” সৈন্যরা সেনাপতির কাছে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “এই সুরায় আল্লাহর গুণাবলী বর্ণিত আছে। তাই আমি এই সুরাটিকে ভালোবাসি।” এই উত্তর শুনে নবী (সাঃ) সাহাবিদের বলেন, “তোমরা তাকে জানিয়ে দাও, আল্লাহও তাকে ভালোবাসেন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৩৭৫; মুসলিম, হাদিস : ৮১৩; নাসায়ি, হাদিস : ২/১৭০)
- একবার এক সাহাবি নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে এসে বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)! আমি সুরা ইখলাসকে ভালোবাসি।” এই কথা শুনে নবী (সাঃ) বলেন, “এই ভালোবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৭৪; তিরমিজি, হাদিস : ২৯০১)
- নবী মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি প্রতিদিন ২০০ বার সুরা ইখলাস পড়বে, তার ৫০ বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। তবে ঋণ থাকলে তা মাফ হবে না।” (তিরমিজি, হাদিস : ২৮৯৮)
উপসংহার
সূরা ইখলাস মুসলিম জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। এর তিলাওয়াতের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে পারি এবং জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারি। মহান আল্লাহ আমাদের মুসলিম উম্মাহকে সূরা ইখলাসের গভীর অর্থ ও ভাবনা অন্তরে ধারণ করার শক্তি দান করুন। আমাদের হৃদয়ে আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর অপরিসীম ক্ষমতার প্রতি অটুট বিশ্বাস স্থাপন করুন। হাদিসে বর্ণিত সূরা ইখলাস তিলাওয়াতের অগণিত ফজিলত ও মর্যাদা লাভ করার তাওফিক আমাদের দান করুন। আমিন। আর্টিকেলটি ভালো লাগলে অবশ্যই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন I ধন্যবাদ।